নিজেদের টাকায় তৈরি পদ্মা সেতু বাংলাদেশের সক্ষমতার পরিচয় বহন করছে। প্রথম মেট্রোরেলের উদ্বোধনও দেখে ফেলেছে দেশবাসী। অপেক্ষা এখন দেশের নদী তলদেশে নির্মিত প্রথম টানেল উদ্বোধনের। আগামী ২৮ অক্টোবর শনিবার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়েছিল সরকার। স্বপ্নের এই প্রকল্প এখন বাস্তবে রূপ নিয়েছে।
শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের কারণে চট্টগ্রাম অঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাপকহারে বাড়বে। এর প্রভাব পড়বে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ছাড়াও পর্যটন নগর কক্সবাজার এবং পার্বত্য জেলা বান্দরবানের সেতুবন্ধ তৈরি করবে। এছাড়া দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হবে শূন্য দশমিক ১৬৬ শতাংশ।
চট্টগ্রাম চেম্বার সূত্র জানায়, আগামী চার বছরে কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ে গার্মেন্টস, জাহাজ নির্মাণ, ভোজ্যতেল, মাছ প্রক্রিয়াকরণ, ইস্পাত, সিমেন্টসহ অন্তত একশ শিল্প কারখানা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান উৎপাদনও শুরু করেছে। চায়না ইকোনমিক জোনে দেশি-বিদেশি অন্তত ১৫ প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে। কোরিয়ান ইপিজেডেও শুরু হয়েছে নতুন ৪টি কারখানার কাজ। টানেল থেকে আধা কিলোমিটার দূরে বাস্তবায়নাধীন রয়েছে সাদ মুছা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক। ব্যবসা-বাণিজ্যের বিশাল সম্ভাবনার সঙ্গে তাল মেলাতে ব্যস্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো।
চট্টগ্রামের সাথে পার্বত্য জেলাসমূহ এবং পর্যটননগরী কক্সবাজারকে ঘিরে ব্যাপকভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে সরকার। এ পরিকল্পনার আওতায় মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল, কর্ণফুলীর ওপাড়ে কোরিয় ইডিজেড, কক্সবাজারের মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অন্যান্য প্রকল্প দেশের অর্থনীতিতে আগামী দিনে সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মুক্ত করতে যাচ্ছে।
দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি ও সাবেক চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, টানেলের মাধ্যমে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের বিস্তৃতি ঘটবে। ব্যবসা ও শিল্পের সমৃদ্ধি ঘটবে। মজবুত হবে আমাদের অর্থনীতির ভিত।
টানেলকে কেন্দ্র করে গত কয়েক বছরে বদলে গেছে আনোয়ারা। কালাবিবির দীঘি এলাকায় এক বছরে নির্মিত হয়েছে অন্তত ২০টি বাণিজ্যিক ও আবাসিক বহুতল ভবন। এখানকার কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে কারখানা স্থাপনের জন্য জমি কিনছে দেশের শীর্ষ শিল্প প্রতিষ্ঠান আকিজ গ্রুপ, ফোর এইচ গ্রুপ, ডায়মন্ড সিমেন্ট, এস আলম গ্রুপ ও পারটেক্স। সেই সাথে জমির দাম ও ভবনের ভাড়া বেড়ে গেছে ১০ থেকে ১৫ গুণ পর্যন্ত। টানেলকে কেন্দ্র করে কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ে গার্মেন্টস, জাহাজ নির্মাণ, ভোজ্যতেল, মাছ প্রক্রিয়াকরণ, ইস্পাত, সিমেন্টসহ অন্তত একশ শিল্প কারখানা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছেন ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তরা। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান উৎপাদনও শুরু করেছে।
আনোয়ারা উপজেলার বারশত ইউনিয়নের বাসিন্দা আবু তৈয়ব বলেন, টানেল দেশের উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতি হবে। বিশেষ করে আনোয়ারার পারকি সৈকত ঘিরে পর্যটন শিল্পের আরও বেশি প্রসার হবে। চট্টগ্রাম শহর থেকে সহজে পর্যটকরা পারকি সৈকতে চলে আসতে পারবেন। পর্যটক বাড়লে বাড়বে রাজস্ব আয়। একই সঙ্গে তা আনোয়ারা উপজেলায় উপশহর গড়ে তোলার দুয়ারও খুলে দেবে।
জানা যায়, টানেল নির্মাণে মোট ব্যয় প্রায় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ও চীন সরকার ‘জি টু জি’ অর্থায়নে টানেলটি নির্মাণ করছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ৪ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। বাকি ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা দিচ্ছে চীন সরকার। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর কর্ণফুলী নদীর তলদেশে স্বপ্নের টানেল নির্মাণকাজের যৌথভাবে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনা রাষ্ট্রপতি শিং জিনপিং। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম টানেল টিউবের বোরিং কাজের উদ্বোধন করেন।
টানেলটি চালু হলে প্রতিদিন ১৭ হাজার ২৬০টি এবং বছরে ৭৬ লাখ যানবাহন চলাচল করতে পারবে। টানেলের সম্ভাব্যতা সমীক্ষার তথ্যানুযায়ী, টানেল চালু হওয়ার পর ২০২৫ সালে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে। এ ছাড়া ২০৩০ সালে যানবাহন চলাচলের প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি। তাছাড়াও ১ লাখ ৬২ হাজার যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২০৬৭ সালে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের প্রকল্প পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ চৌধুরী বলেন, টানেলের মূল কাজ শেষ। ভেতরে শেষ মুহূর্তের সিভিল, মেকানিক্যাল, ইলেকট্রিক ও সাজসজ্জার কাজও শেষ। কয়েকবার ট্রায়াল রানও করা হয়েছে। আগামী ২৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী টানেল উদ্বোধন করবেন। পরের দিন থেকেই যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, সমীক্ষা অনুযায়ী ২০২৫ সালে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে। যেহেতু যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হচ্ছে, তাই সমীক্ষার চেয়ে কয়েকগুণ বাড়তে পারে।
বাংলাদেশ জার্নাল/ওএফ